ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রেক্ষাপট
ক্রিপস মিশন
পটভূমি বা কারণ :
- জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনা : ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করে এবং জাপান অতিদ্রুত ফিলিপাইন , ইন্দোচিন , ইন্দোনেশিয়া , মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে ( ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজির হয়। কলকাতায় বোমা বর্ষণ করে।
- মিত্রশক্তির চাপ : এই পরিস্থিতিতে ভারতের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। এই সহযোগিতা পাওয়ার জন্য চিনের রাষ্ট্রপতি চিয়াং-কাই-শেক ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ব্রিটেনকে ভারত সম্পর্কে মনোভাব পরিবর্তনের জন্য চাপ তৈরি করে।
- ব্রিটিশ রাজনীতিকদের চাপ :ব্রিটেনের শ্রমিক দলের ( Labour Party ) নেতা ক্লিমেন্ট এটলি ও অন্যান্য ব্রিটিশ রাজনীতিবিদগণ যুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য নেওয়ার কথা বলেন ।
- এই পরিস্থিতিতে ১১ই মার্চ চার্চিল যুদ্ধে ভারতের পূর্ণ সহযোগিতা লাভ ও ভারতের সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলি নিয়ে আলোচনার জন্য স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে ভারতে পাঠানোর কথা ঘোষণা করে।
ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব :সস্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক সপ্তাহ ধরে আলােচনার পর ২৯ মার্চ একগুচ্ছ প্রস্তাব রাখেন, যা 'ক্রিপস প্রস্তাব' নামে পরিচিত।
- যুক্তরাষ্ট্র : যুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরেই ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্র (Union) প্রতিষ্ঠা করা হবে।
- ডোমিনিয়ন : যুদ্ধের পর ভারতকে 'ডোমিনিয়ন'-এর মর্যাদা দেওয়া হবে।
- সংবিধান সভা : ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠন করা হবে।
- সংবিধান সভার সদস্য : প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নিম্নকক্ষ দ্বারা নির্বাচিত এবং দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিরা দেশীয় রাজাদের দ্বারা মনোনীত হবেন।
- সংবিধান রচনা :এই সংবিধান সভা ভারতের নতুন সংবিধান রচনা করবে।
- সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাসংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য স্বতন্ত্র সংবিধান চালু হবে।
- দেশীয় রাজ্য : ভারতের কোনো প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য এই সংবিধান গ্রহণে রাজি না হলে সেই প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য নিজের সংবিধান রচনা করবে।
- সেনাবাহিনী : সংবিধান রচিত হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ওপর ব্রিটিশ সরকারের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে।
- ভারতীয় সম্পদ : ভারতীয়দের সহযোগিতায় ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সম্পদ যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করবে।
- কার্যনির্বাহী পরিষদ : বড়লাটের কার্যনির্বাহী পরিষদে আপাতত বেশি সংখ্যক ভারতীয় সদস্য নেওয়া হবে।
ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া :ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণ করেন নি। কেবলমাত্র মানবেন্দ্রনাথ রায়ের 'র্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি' একে স্বাগত জানায়।
- কংগ্রেসের বিরোধিতার কারণ
- এই প্রস্তাবটিতে পূর্ণ স্বাধীনতা-দানের কোনাে উল্লেখ ছিল না।
- প্রদেশগুলিকে বিচ্ছিন্ন থাকার অধিকার প্রদান।
- গণপরিষদে দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিরা মনোনীত হবেন, নির্বাচিত নয়।
- প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণ না থাকা।
- অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের কথা না থাকা।
- মুসলিম লিগের বিরোধিতা :
- পৃথক পাকিস্তানের সুনিশ্চিত প্রতিশ্রূতি ছিল না।
- নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংবিধান সভা গঠিত হলে হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
- শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ভারতীয় শিখ সম্প্রদায়ও ক্রিপস্ প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনি । তাদের আশঙ্কা ছিল পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা ভারত থেকে আলাদা হয়ে গেলে শিখদের স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়বে ।
- হরিজন সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াহরিজন সম্প্রদায়ের নেতা আম্বেদকর এই ভেবে অসন্তোষ প্রকাশ করেন যে , ক্রিপস্ প্রস্তাব কার্যকরী হলে বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে ।
গান্ধিজী এই প্রস্তাবকে এটি "একটি দেউলিয়া ব্যাংকের মেয়াদোত্তীর্ণ চেক।" (a post-dated cheque on a crushing Bank) চেকের সঙ্গে তুলনা করে 'দুর্ভাগ্যজনক প্রস্তাব' বলে অভিহিত করেছেন।
ওয়াভেল পরিকল্পনা ও সিমলা বৈঠক (Wavell Plan and Shimla Conference of 1945 )
ওয়াভেল পরিকল্পনাভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় তা দূর করার জন্য ভাইসরয় লর্ড আর্কিবল্ড ওয়াভেল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৪ জুন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের কাছে একটি খসড়া পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন । এটিই ওয়াভেল পরিকল্পনা নামে পরিচিত।
ওয়াভেল পরিকল্পনার সুপারিশলর্ড ওয়াভেল ক্রিপস প্রস্তাবকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করার জন্য যে সকল সুপারিশ করেছিলেন সেগুলি হল—
- বড়লাটের শাসন পরিষদ এমনভাবে পুনর্গঠন করা হবে, যাতে বড়লাট ও প্রধান সেনাপতি ছাড়া এ পরিষদের সকল সদস্যই ভারতীয় হবেন।
- শাসন পরিষদে হিন্দু ও মুসলমান সদস্যদের সংখ্যা সমান হবে।
- ব্রিটিশ সরকার যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ক্ষমতা হস্তান্তর করবে এবং ভারতবাসী তাদের নিজস্ব সংবিধান রচনা করবে।
- ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকারের হাতেই থাকবে।
- নতুন সংবিধান গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় নেতাদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে।
- এই সরকারে হিন্দু, মুসলিম এবং অন্যান্য অনুন্নত সম্প্রদায়ের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকবে
সিমলা বৈঠক
- উপরোক্ত প্রস্তাবগুলি আলােচনা করার জন্য লর্ড ওয়াভেল সিমলাতে এক সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন (২৫ জুন, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে)। বৈঠক চলে ২৫ জুন থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত ।
- এই বৈঠকের মূল আলােচ্য বিষয় ছিল -
- বড়ােলাটের কাউন্সিল বা শাসন পরিষদ যে সমস্ত নীতির ভিত্তিতে কাজ করবে সেগুলি ঠিক করা।
- কাউন্সিল কীভাবে গঠিত হবে বা এই কাউন্সিলের কারা সদস্য হবে তা ঠিক করা।
- কংগ্রেসের পক্ষে মৌলানা আজাদ ও মুসলিম লিগের পক্ষে জিন্না এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
ওয়াভেল পরিকল্পনার পরিণতি
- স্বায়ত্তশাসন অর্জনে লিগের সঙ্গে ঐক্যমত গড়ে তােলার জন্য কংগ্রেস, বড়লাটের শাসন পরিষদে মুসলিমদের সমপ্রতিনিধিত্বের দাবি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু হিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত ৫ টি আসনের মধ্যে ১টিতে একজন মুসলমান সদস্য মনােনয়নের দাবি জানায়। কারন এ সময় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন আবুল কালাম আজাদ।
- কিন্তু লীগ সভাপতি জিন্নাহ দাবি করেন যে, যেহেতু মুসলিম লীগ ভারতের মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র সেহেতু মুসলিম লীগ বড়লাটের শাসন পরিষদে সকল মুসলিম সদস্য মনােনীত করার অধিকারী।
- জিন্নাহ ও কংগ্রেস কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়ায় সিমলা সম্মেলন তথা ওয়াভেল পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
মন্ত্রী বা ক্যাবিনেট মিশন
- ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের পরিকল্পনা অনুসারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলির পূর্ব ঘােষণা অনুযায়ী ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ভারতে আসে।
- ভারত সচিব স্যার পেথিক লরেন্স, নৌবাহিনীর প্রধান এ.ভি. আলেকজান্ডার ও বাণিজ্য বাের্ডের সভাপতি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার এই তিনজন সদস্যকে নিয়ে প্রতিনিধিদল গঠিত হয়। এটি মন্ত্রী বা ক্যাবিনেট মিশন নামে পরিচিত হয়।
উদ্দেশ্য
- ভারতকে স্বাধীনতা দান এবং ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার জন্য যে গণপরিষদ তৈরি হবে তার গঠন , পদ্ধতি ও নীতি নির্ধারণ করা ।
- ভারতের সকল রাজনৈতিক দলগুলির বৃহত্তর মতৈক্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালের জন্য একটি জনপ্রতিনিধি ভিত্তিক সরকার গঠন করা ।
প্রস্তাব
- যুক্তরাষ্ট্র গঠন: ভারতবর্ষে একটি যুক্তরাষ্ট্র (Federal Union) গঠিত হবে। দেশীয় রাজ্যগুলি পরবর্তীকালে এই যুক্তরাষ্ট্রে যােগ দিতে পারবে।
- ক্ষমতা বণ্টন: কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে । কেবলমাত্র পররাষ্ট্র , প্রতিরক্ষা ও যােগাযােগ বিষয়ক ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর । বাকি ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের হাতে ।
- প্রদেশ গঠন: ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলিকে তিনটি বিভাগে বিভক্ত করা হবে—
- মাদ্রাজ , বােম্বাই , উত্তরপ্রদেশ , বিহার , মধ্যপ্রদেশ ও ওড়িশা নিয়ে গঠিত হিন্দু প্রধান বা ক বিভাগ
- পাঞ্জাব , উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ , সিন্ধু নিয়ে গঠিত মুসলিম প্রধান বা খ বিভাগ
- বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি পৃথক বিভাগ বা গ বিভাগ
- এই বিভাগগুলির নিজ নিজ আঞ্চলিক সংবিধান প্রণয়নের অধিকার থাকবে
- গণপরিষদ গঠন:ভারত যুক্তরাষ্ট্রে যােগদানে ইচ্ছুক দেশীয় রাজ্য ও প্রদেশগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হবে।
- যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের অধিকার: নতুন সংবিধান অনুসারে নির্বাচনের পর কোনাে রাজ্য ইচ্ছা করলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করতে পারবে।
- অন্তর্বর্তী সরকার: নতুন সংবিধান চালু না হওয়া পর্যন্ত প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার শাসন লিনা করবে।
মন্ত্রী মিশনের ত্রূটি
- ভারত বিভাজনের পথ প্রস্তুত: মন্ত্রী মিশন সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত ভাগের প্রস্তাব রাখেন। মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে প্রদেশগুলিকে হিন্দু প্রধান ও মুসলিম প্রধান— এই দু-ভাগে ভাগ করার উল্লেখ থাকায় পরােক্ষভাবে ভারত বিভাজনের পথই প্রস্তুত হয়। মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব অনুসারে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা লক্ষ্য করে মুসলিমগণ সন্তুষ্ট হলেও কংগ্রেসের মনঃপুত হয় নি । কিন্তু ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসকে অন্তর্বর্তী সরকার ও সংবিধান সভাকে যথাসম্ভব স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিলে কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করে ।
- দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে: মন্ত্রী মিশন প্রদেশগুলিকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং কেন্দ্রের হাতে শুধুমাত্র পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও যােগাযােগ ব্যবস্থার দায়িত্ব অর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের রূপরেখা ফুটে ওঠে।
মন্ত্রী মিশনের গুরুত্ব১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবগুলি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
- ভারতকে অবিভক্ত রাখার প্রয়াস: মিশন স্পষ্টই বুঝে গিয়েছিল যে, ভারত ভেঙে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই ভারতকে অবিভক্ত রেখে স্বাধীনতা দেওয়া—এটাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের শেষ আন্তরিক প্রয়াস।
- প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার: এই প্রথম দেশীয় রাজ্যের জনগণকে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।
- অসাম্প্রদায়িক শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপ: এতদিন শাসনতান্ত্রিক আলােচনার ক্ষেত্রে ভারতের বিভিন্ন গােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকে কেন্দ্র করে নানা জটিলতার সৃষ্টি হত। এর থেকে মুক্তি পেতে মন্ত্রী মিশন হিন্দু, মুসলিম ও পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে শিখ ছাড়া অন্য কোনাে সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি না দিয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করে।
- অ-ভারতীয় সদস্য গ্রহণ: গণপরিষদে কোনাে অ-ভারতীয় সদস্য গ্রহণের প্রস্তাব ছিল না।
- গণপরিষদের ক্ষমতা: ভারতীয় শাসনতন্ত্র রচনার ক্ষেত্রে গণপরিষদকেই সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়।
জিন্নাহর প্রত্যক্ষ সংগ্রাম
- লর্ড ওয়াভেল কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরুকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে আহ্বান জানান । এতে মহম্মদ আলি জিন্নাহ ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে পাকিস্তান দাবি আদায়ের জন্য ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস-এর ডাক দেন ।
- দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ওই দিনটি শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হলেও কলকাতা, নোয়াখালি এবং ত্রিপুরায় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা বেধে যায় । অসংখ্য জীবনহানি, সম্পত্তি নাশ, লুঠতরাজের মধ্যে দিয়ে দিনটি অতিবাহিত হয় । বাংলার দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আগুন জ্বলে ওঠে । আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি হয় ।
- কেন্দ্রে ওয়াভেল সরকার কিংবা রাজ্যে লিগ সরকার কেউই এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিবারণে কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি বা নেওয়ার চেষ্টা করে নি ।
- জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে মুসলিম লিগ বড়লাটের অনুরোধে এই সরকারে যোগদান করলেও কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ সদস্যরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে সক্ষম হন নি । ফলে সরকারি প্রশাসনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় ।
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা (The Mountbatten Plan)
- দেশব্যাপী চরম উত্তেজনার মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ঘোষণা করেন যে, ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা প্রত্যার্পণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন ।
- এ বিষয়ে প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করার জন্য ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে মার্চ লর্ড ওয়াভেলের স্থলাভিষিক্ত হয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেন দাঙ্গাবিধ্বস্ত ভারতে বড়লাট হয়ে আসেন ।
- ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন প্রায় দেড় মাসের মধ্যে ( ১৯৪৭ খ্রি. ৬ মের মধ্যে ) গান্ধীজি , জওহরলাল , বল্লভভাই প্যাটেল , জিন্না ও দেশীয় রাজাদের সঙ্গে প্রায় ১৩৩ বার বৈঠকে বসেন ।
- তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম নেতাদের বোঝালেন যে, দেশবিভাগ অনভিপ্রেত হলেও তত্কালীন রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে সব পক্ষেরই উচিত তা মেনে নেওয়া ।
- এর পরই তিনি বাস্তবসম্মত এবং সকলের পক্ষে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করেন । তিনি একই সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং ভারত বিভাগের প্রস্তাব রাখেন ।
এই পরিকল্পনা অনুসারে স্থির হল যে
- ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি ডােমিনিয়নের সৃষ্টি করা হবে । ডােমিনিয়ন দুটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয় সমূহ পরিচালনা করবে ।
- মুসলমান প্রধান প্রদেশ সিন্ধু , ব্রিটিশ বালুচিস্তান , উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ , পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলা নিয়ে ‘ পাকিস্তান ’ গড়া হবে ।
- বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশ দুটি বিভক্ত হবে । প্রদেশ দুটি বিভাগের সময় কোন কোন অঞ্চল কোন ডোমিনিয়ানের সঙ্গে থাকবে তা ঠিক করবে সিরিল র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে গঠিত 'বর্ডার কমিশন' ।
- উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ ও শ্রীহট্টে গণভোট দ্বারা স্থির হবে সে সব অঞ্চলের জনগণ 'ভারত' বা 'পাকিস্তান' কোন ডোমিনিয়ানের সঙ্গে থাকবেন ।
- দেশীয় রাজ্যগুলি নিজ নিজ রাজ্যে সার্বভৌম ক্ষমতা লাভ করবে এবং ইচ্ছা করলে তারা যে-কোনাে ডােমিনিয়নে যােগ দিতে পারবে ।
- প্রতি ডােমিনিয়নের নির্বাচিত গণপরিষদ নিজ এলাকার সংবিধান রচনা করবে।
- যতদিন না সংবিধান রচিত হচ্ছে ততদিন ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত একজন গভর্নর-জেনারেল ওই ডােমিনিয়নে থাকবেন।
- স্বাধীনতা লাভের পর প্রতি ডােমিনিয়নের নির্বাচিত আইনসভা নিজ নিজ দেশের জন্য আইন রচনা করবে।
1947 সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইন
- লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় পাঠান । ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাবটি অনুমোদনের পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি সেটি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পেশ করেন ।
- ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই ভারতীয় স্বাধীনতা আইন বিনা বাধায় পাস হয়ে যায় ।
- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ই জুলাই ভারতের স্বাধীনতা বিলটি রাজকীয় সম্মতি লাভের পর 'ভারতীয় স্বাধীনতা আইন -১৯৪৭ (Indian Independence Act of 1947)' -এ পরিণত হয় ।
ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের শর্ত বা ধারা বা বৈশিষ্ট্য:-
- ভারতবর্ষকে বিভক্ত করা হবে এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ‘ ভারত ’ ও ‘ পাকিস্তান ’নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করবে ।
- দুটি রাষ্ট্রের ওপর থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সমস্ত অধিকার লুপ্ত হবে । উভয় রাষ্ট্রই স্বাধীনভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার পরিচালনা করবে এবং সংবিধান রচনা করবে ।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:-
- জওহারলাল নেহরু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন ।
- ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ গণপরিষদের সভাপতি এবং মাউন্টব্যাটেন গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন ।
- মহম্মদ আলি জিন্নাহ হন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল ।
- জওহারলাল নেহরু ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ই আগস্ট মধ্যরাত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের এক জরুরি বৈঠক ডেকে চরম উচ্ছ্বাসে বলেন, "মধ্যরাত্রে সমগ্র পৃথিবী যখন নিদ্রামগ্ন ভারত তখন জীবন ও স্বাধীনতার আনন্দে জেগে উঠবে ।" (At the stroke of the midnight hour when the world sleeps India will awake to life and freedom.) ।